
ঠিক ২৮ বছর আগে, ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পুরো বিশ্বকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মহীয়সী এক নারী। আর্তমানবতার সেবায় নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করা এই নারীর নাম মাদার তেরেসা। ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছা থেকে ১২ বছরের যে কিশোরী সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তিনি ১৯২৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে জাহাজে চেপে সাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসেন তৎকালীন ভারতবর্ষের কলকাতায়।
সেখানে মানুষের দুঃখ–দুর্দশা তেরেসাকে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়। ভারতের মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি; ক্ষুধার্ত, আর্ত, রোগাক্রান্ত ও নিঃস্ব মানুষের ডাকে সাড়া দিতে কাজ শুরু করেন, সিস্টার মেরি তেরেসা থেকে হয়ে ওঠেন মাদার তেরেসা।
জন্ম ও শৈশব
১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন মেসিডোনিয়ার স্কোপিতে জন্ম হয় এক শিশুর। মা-বাবা নাম রাখেন অ্যাগনেস গনঝে বোজাক্সিউ, ডাক নাম গোনঝে। গোনঝে মূলত একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ ‘ফুলের কলি’। তিন ভাই-বোনের মধ্যে অ্যাগনেস সবার ছোট। তাঁর বাবা নিকোলা বোজাক্সিউ ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ।
মায়ের নাম দ্রেইনা। তাঁরা ছিলেন আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে সুখী পরিবার ছিল তাঁদের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারান অ্যাগনেস। শুধু বাসস্থানটুকু ছাড়া সর্বস্ব হারিয়ে মহাবিপদে পড়তে হয় পরিবারটিকে। মা ও বড় বোন মিলে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিতে থাকেন।

অসহায় মানুষদের জন্য কলকাতায় নির্মল হৃদয় গড়ে তুলেছিলেন মাদার তেরেসাফাইল ছবি: রয়টার্স
সন্ন্যাসিনী হওয়ার পথে যাত্রা
১২ বছর বয়সে সন্ন্যাসিনী হয়ে সৃষ্টিকর্তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন অ্যাগনেস। এর প্রায় ছয় বছর পর ১৯২৮ সালে সেই সুযোগ আসে। ১৮ বছর বয়সে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করতে আয়ারল্যান্ডে যান। সেখানে গিয়ে লোরেটা সিস্টারদের সঙ্গে যোগ দেন।
‘সিস্টার্স অব লোরেটো’ হচ্ছে মিশনারি মেয়েদের দল। তাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মপ্রচারের কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তেরেসাও এই কাজ করতে চান।
আয়ারল্যান্ডে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর ভারতবর্ষের উদ্দেশে জাহাজে চেপে বসেন তেরেসা, ১৯২৯ সালে ভারতের কলকাতায় পৌঁছান। এরপর সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
কলকাতায় তখন একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছে, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ঠিক ওই সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত যে মানুষগুলোর দিক থেকে হাসপাতালও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তাদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন মাদার তেরেসা।
১৯৩১ সালে অ্যাগনেস সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ নেন। সেন্ট তেরেসার নামানুসারে ‘সিস্টার মেরি তেরেসা’ নাম গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সেন্ট মেরি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। পড়াতেন ভূগোল, ইতিহাস ও ক্যাথেসিজম। পাশাপাশি চলছিল বাংলা ও হিন্দি ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা। একসময় তিনি স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান।
শিক্ষকতা করার ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন কলকাতা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে বেড়াতেন মাদার তেরেসা। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। হাজার হাজার মানুষ অনাহারে প্রাণ হারায়।
এমন এক পরিস্থিতিতে বস্তিবাসীর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখতে বস্তিতে বস্তিতে যেতেন তেরেসা। চেষ্টা করতেন তাঁদের সাহায্য করার। এভাবে ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে তিনি আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষুধার্ত ও নিঃস্ব মানুষের ডাকে সাড়া দিতে কাজ শুরু করেন।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি
বছর চারেক পর ১৯৫০ সালে জনহিতৈষী প্রতিষ্ঠান ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ গড়ে তোলেন তেরেসা। ১৯৫২ সালে এই চ্যারিটির অধীনেই গড়ে ওঠে ‘নির্মল হৃদয়’। এটি মুমূর্ষু মানুষের আশ্রয় ও সেবাকেন্দ্র। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে সেবাকেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়।
নির্মল হৃদয়ের আদি নাম ‘হোম ফর দ্য ডাইং’। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র। এ ছাড়া কুষ্ঠরোগীদের জন্য গড়ে তোলেন ‘শান্তিনগর’।
মাদার কখনো হাসপাতাল চালাননি; আমরা শুধু তাদের আশ্রয় দিই, যাদের হাসপাতালেও জায়গা হয় না…সিস্টার ও স্বেচ্ছাসেবীদের মূল লক্ষ্য থাকে খাবার দেওয়া এবং ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার ওপর; কারণ, অনেক আহত মানুষ রোজ এখানে আসেন
…সিস্টার মেরি প্রেমা পিরিক, কলকাতায় মিশনারিজ অব চ্যারিটির সাবেক মাদার সুপিরিয়র
এরপর ধীরে ধীরে কলকাতার বাইরেও মিশনারিজ অব চ্যারিটির সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন মাদার তেরেসা। ১৯৬৫ সালে বিশ্বব্যাপী কাজ করার অনুমতি পান। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরে প্রথম শাখা খোলা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে এই চ্যারিটির শাখা রয়েছে।
যত বিতর্ক-সমালোচনা
মাদার তেরেসার কাজ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক ক্রিস্টোফার হিচেনস। তিনি তথ্যচিত্র হেলস অ্যাঞ্জেল (১৯৯৪) ও তাঁর বই ‘দ্য মিশনারি পজিশন: মাদার তেরেসা ইন থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’–এ (১৯৯৫) মাদার তেরেসার বিরুদ্ধে দাতব্য তহবিলের অপব্যবহার, নিম্নমানের চিকিৎসাসেবা এবং যন্ত্রণা লাঘব না করে বরং কষ্টকে মহিমান্বিত করার অভিযোগ করেছেন।
আধুনিক গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ বারবার জোরালোভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় জনমনে তা প্রভাব ফেলেছে এবং অনেকে মাদার তেরেসার মিশনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

১৯৮২ সালে বৈরুতে মাদার তেরেসাছবি: এএফপি
মাদার তেরেসার মানব সেবার ধরন
মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির অধীনে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো আদতে কোনো হাসপাতাল নয়। বরং সেখানে মৃত্যুপথযাত্রীদের আশ্রয় দেওয়া, অসহায়দের মধ্যে খাবার বিতরণ, অনাথাশ্রম এবং গৃহহীন, প্রতিবন্ধী ও দুর্যোগকবলিত মানুষদের সহায়তা দেওয়া জন্য তৈরি।
তবে অনেকেই ভাবেন, মিশনারিজ থেকে হাসপাতাল পরিচালনা করা হয়। মাদার তেরেসার কার্যক্রম নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁদের মূল অভিযোগগুলোর একটি এটি।
স্বাধীনতার পর ভারত সরকার আফিমের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এমনকি আইনের মাধ্যমে চিকিৎসাজনিত কারণেও আফিমের ব্যবহার সীমিত করা হয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলে না, মিশনারিজ অব চ্যারিটি হাসপাতাল নয় বরং হসপিস পরিচালনা করে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। হসপিস মৃত্যুপথযাত্রীদের আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে চিকিৎসা দেওয়া হয় না বরং জীবনের শেষ দিনগুলোতে একজন মানুষকে সর্বোচ্চ আরাম, মর্যাদা ও সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হেল্থ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসে স্পষ্ট করে বলা আছে, হসপিস কেয়ার বা মৃত্যুপথযাত্রীদের সেবা মূলত সেসব রোগীর জন্য, যাদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। তাই তাদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা না করে তাদের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘবের চেষ্টা করা হয়। তবে এ জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্রে রোগীদের আয়ুসাধারণত ছয় মাস বা তার কম বলা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ১৭ লাখ মেডিকেয়ার সুবিধাভোগী হসপিস সেবা গ্রহণ করেন।
মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে মূলত গরিব মানুষদের হসপিস সেবা দেওয়া হয়।
১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা যখন তাঁর প্রথম হসপিস সেবা চালু করেন, তখন আধুনিক ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ বা উপশমমূলক সেবা ধারণার অস্তিত্বই ছিল না। ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক সিসিলি সন্ডার্সের হাত ধরে প্রথম আধুনিক হসপিসের যাত্রা শুরু হয়।
‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ বা উপশমমূলক পরিচর্যা ধারণার জনপ্রিয় হয় আরও পরে, ১৯৭৪ সালে। আর ব্যথানাশক ব্যবস্থাপনাকে মানসম্মত রূপ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘থ্রি-স্টেপ পেইন ল্যাডার’ চালু হয় ১৯৮৬ সালে। অথচ, এর ৩৪ বছর আগে মাদার তেরেসা ঠিক এ কাজটিই শুরু করেছিলেন। হাসপাতালও যাদের ফিরিয়ে দিত, তাদের আশ্রয় দিতেন মাদার তেরেসা।
মাদার তেরেসা সন্ত স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাঁর ৩০ বছরের সহকর্মী বলেছিলেন, ‘তিনি ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন, ফলে তাঁর কাউকে ধর্মান্তরিত করার প্রশ্নই ওঠে না। সেটা কখনোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, আর তা–ই যদি হতো, আমার তো মনে হয়, গোটা ভারত এত দিনে খ্রিষ্টান হয়ে যেত।
…সুনীতা কুমার, মাদার তেরেসার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও বন্ধু
কলকাতায় মিশনারিজ অব চ্যারিটির সাবেক মাদার সুপিরিয়র সিস্টার মেরি প্রেমা পিরিক মাদার তেরেসার কাজের ধরন স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মাদার কখনো হাসপাতাল চালাননি; আমরা শুধু তাদের আশ্রয় দিই, যাদের হাসপাতালেও জায়গা হয় না। সিস্টার ও স্বেচ্ছাসেবীদের মূল লক্ষ্য থাকে খাবার দেওয়া এবং ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার ওপর; কারণ, অনেক আহত মানুষ রোজ এখানে আসেন।’

মাদার তেরেসার মৃত্যুবার্ষিকীতে কলকাতার মাদার হাউসে অসহায় শিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হচ্ছেফাইল ছবি: এএফপি
সিস্টার মেরি প্রেমা আরও বলেন, তিনি (মাদার তেরেসা) কখনো অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেননি। বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল পরিত্যক্ত ও মৃত্যুপথযাত্রীদের তাদের শেষ সময়ে মর্যাদা, ভালোবাসা ও সান্ত্বনা দেওয়া। আজকের মানদণ্ডে তাঁর কাজের মূল্যায়ন করা কঠিন, এটা অনেকটা যুগ বৈপরীত্যের মতো হবে।
মাদার তেরেসা যে সময়ে কলকাতায় কাজ শুরু করেন, তখন ভারত দীর্ঘ পরাধীনতার শেকল ভেঙে সদ্য স্বাধীন এক দেশ। সমাজের উঁচুতলা থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গভীর বিভাজন-অবিশ্বাস ছড়িয়ে ছিল, অর্থনীতি ধসে পড়েছিল এবং দেশজুড়ে চরম দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট ছিল।
কলকাতায় তখন একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছে, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। ঠিক ওই সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত যেসব মানুষের দিক থেকে হাসপাতালও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তাদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন মাদার তেরেসা।
ব্যথানাশক নিয়ে বিতর্ক
যাঁরা মাদার তেরেসার সমালোচনা করেন, তাঁদের বড় একটি অভিযোগ, তিনি ইচ্ছা করে মৃত্যুপথযাত্রীদের ব্যথানাশক ওষুধ দিতেন না, যাতে তাঁরা অধিক যন্ত্রণা ভোগ করেন।
এই অভিযোগটির উৎস ক্রিস্টোফার হিচেনস। তিনি তাঁর ‘দ্য মিশনারি পজিশন: মাদার তেরেসা ইন থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ বইয়ে দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত ড. রবিন ফক্সের একটি নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেন। ড. ফক্স তাঁর নিবন্ধনে লিখেছেন, তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে মাদার তেরেসার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় কড়া ডোজের ব্যথানাশক পাওয়া যেত না।
যদিও ড. ফক্স মিশনারিজ অব চ্যারিটির সবার জন্য দ্বার খোরা রাখার নীতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সহানুভূতিশীল পরিচর্যার প্রশংসা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, সেখানে তাঁর দেখা অনেক রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তা ছাড়া, ফক্স এমন দাবিও কখনো করেননি যে ইচ্ছা করে ব্যথানাশক দেওয়া হয় না। তিনি শুধু বলেছেন, সেখানে কড়া ডোজের ব্যথানাশ পাওয়া যেত না। এর কারণ সম্ভবত ওই সময়ের সরকারব্যবস্থা।
স্বাধীনতার পর ভারত সরকার আফিমের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এমনকি আইনের মাধ্যমে চিকিৎসাজনিত কারণেও আফিমের ব্যবহার সীমিত করা হয়।
১৯৪৯ সালের অল ইন্ডিয়া আফিম কনফারেন্স থেকে শুরু করে আগের কয়েকটি আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে আফিমের ব্যবহার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও চিকিৎসার উদ্দেশ্য ছাড়া আফিমের বিক্রি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর নর্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যানসেস অ্যাক্টের (১৯৮৫) মাধ্যমে আফিমজাত ওষুধের ব্যবহারও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়। এর ফলে হাসপাতালেও ব্যথানাশক ওষুধ দুর্লভ হয়ে পড়ে।
তাই, মাদার তেরেসা ও তাঁর নানরা ইচ্ছা করে রোগীদের ব্যথানাশক দিতেন না এমনটা বলে দেওয়া পুরোপুরি যৌক্তিক হবে না। বরং তাঁরা নিজেদের হাতে থাকা সীমিত সম্পদ দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন।
যন্ত্রণাকে মহিমান্বিত করা নিয়ে বিতর্ক
মাদার তেরেসা সব সময় গরিবদের দুঃখ–কষ্ট–যন্ত্রণাকে তাদের শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের কষ্টকে তিনি যিশু খ্রিষ্টের যন্ত্রণার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ক্রিস্টোফার হিচেনস মাদার তেরেসার সমালোচনা করতে গিয়ে এ বিষয়টির উল্লেখ করেছেন।
তাঁর যুক্তি, এভাবে মাদার তেরেসা দুঃখ ও যন্ত্রণাকে মহিমান্বিত করতেন।
ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্বে যে যন্ত্রণার কথা বলা আছে, তার অর্থ প্রায়শই ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। পরিত্রাণমূলক যন্ত্রণার ধারণা অনুযায়ী, যখন কোনো ব্যথা খ্রিষ্টের ভোগান্তির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সেটি আধ্যাত্মিক বা নৈতিক মূল্য বহন করতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে মানুষকে কষ্ট খুঁজে নিতে হবে বা মানুষের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া উচিত।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের কষ্ট লাঘব করতে। স্বজন পরিত্যক্ত নিঃস্ব মানুষদের খাবার, আশ্রয় ও পরিচর্যা দিতে। যদি মাদার তেরেসা মনে করতেন যে কষ্ট সহ্য করা উচিত তাহলে তিনি যন্ত্রণাকাতর মানুষদের সেবা করতেন না।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে সিস্টার মেরি প্রিমা পিরিক বলেছেন, ‘মাদার কখনোই চাইতেন না, কেউ শুধু কষ্ট করার জন্য কষ্ট ভোগ করুক। বরং মাদার তেরেসা সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করতেন তাদের কষ্ট লাঘব করতে।’

২০১৬ সালে মাদার তেরেসাকে ‘সন্ত’ ঘোষণা দেন পোপ ফ্রান্সিসফাইল ছবি: এএফপি
চিকিৎসায় দ্বিচারিতা নিয়ে বিতর্ক
মাদার তেরেসার সমালোচনাকারীদের আরেকটি বড় দাবি, তাঁর কেন্দ্রে আসা দরিদ্র মানুষেরা যথাযথ মানের চিকিৎসাসেবা পান না। কিন্তু তিনি নিজের জন্য উন্নতমানের চিকিৎসা চেয়েছিলেন। অবশ্য সমালোচকেরা এ দাবি করলেও দাবির পক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
বরং সুযোগ থাকার পরও উন্নত মানের চিকিৎসা নিতে মাদার তেরেসার অনীহা প্রকাশের প্রমাণ আছে। ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং মাদার তেরেসার জীবনী লেখক নবীন বি. চাওলা বলেন, ১৯৯৪ সালে অসুস্থ হয়ে পড়লে মাদার তেরেসাকে দিল্লির একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নতমানের চিকিৎসা চাওয়া দূরে থাক, তিনি হাসপাতালে ভর্তিই হতে চাননি।
এমনকি চিকিৎসকেরা তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া নিয়েও সংশয়ে ছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল, যদি তিনি তাঁদের চিকিৎসা তত্ত্বাবধানে মারা যান, তবে দায় তাঁদের ওপর পড়তে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা বিদেশে মাদার তেরেসার চিকিৎসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
এ বিষয়ে মাদার তেরেসার দীর্ঘদিনের সহযোগী সুনীতা কুমার জানিয়েছিলেন, নিউইয়র্ক ও সান ডিয়াগোর চিকিৎসকেরা যখন মাদার তেরেসাকে দেখতে ভারতে আসেন, তখন তিনি তাঁদের দেখাতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। পরে আশপাশের মানুষদের চাপে পড়ে বাধ্য হন।
মাদার তেরেসার জীবনের শেষ কয়েক বছরে তাঁকে চিকিৎসা দিতেন ডাক্তার প্যাট্রিসিয়া ওবেনেল। পরে এই চিকিৎসক বলেছিলেন, তিনি জীবনে যত রোগী দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ছিলেন মাদার তেরেসা। কারণ, তিনি বিশ্রাম নিতেন না এবং চিকিৎসা দিতে বাধা দিতেন।
তাই, মাদার তেরেসার বিরুদ্ধে চিকিৎসাসেবা পাওয়া নিয়ে যে দ্বিচারিতার অভিযোগ, তা ধোপে টেকে না। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাঁর উন্নত চিকিৎসাসেবা নেওয়ার অনেক সুযোগ ছিল।
ধর্মান্তর করা নিয়ে বিতর্ক
মাদার তেরেসাকে নিয়ে সমালোচকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ সম্ভবত গরিব মানুষকে ধর্মান্তর করা নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ, তাঁর কাছে সেবা নিতে আসা মানুষদের তিনি খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতেন।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি জোরালোভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কলকাতার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির সঙ্গে কাজ করছে।
দলের একজন মুখপাত্র সুনীতা কুমার বলেন, ‘তিনি সবাইকে একই রকম ভালোবাসা দিয়ে দেখাশোনা করতেন। হোক তাঁরা মুসলিম, হিন্দু, বা শিখ।’ সুনীতা নিজেও একজন হিন্দু।
ছন্দা চক্রবর্তী নামে আরেক স্বেচ্ছাসেবক কয়েক বছর আগে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এ সব অভিযোগ ভুয়া। সমালোচকেরা মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি কালীঘাটে যান, দেখবেন বহু মানুষ মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের বেশির ভাগই (আশ্রমে সেবাযত্নে) জীবন ফিরে পেয়েছে। যদি আশ্রমের লোকজন তাদের সুস্থ করে তোলার বিষয়ে এতটাই বেখেয়াল হতো, তবে কীভাবে মরতে বসা ওই মানুষগুলো জীবন ফিরে পেল?’
সুনীতা বলেন, ‘যখন আমি তাঁর সঙ্গে প্রার্থনা করতে যেতাম, তিনি বলতেন, ‘সুনীতা, চ্যাপেলে এসো, তুমি যেমন করে প্রার্থনা করো তেমন করেই বসো। আর আমি যেমন বসি তেমন বসব, এবং আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করব।’
তহবিলের অপব্যবহার নিয়ে বিতর্ক
সারা বিশ্ব থেকেই মিশনারিজ অব চ্যারিটির জন্য তহবিল আসে। কিন্তু সেই অর্থ কীভাবে কোন খাতে খরচ হয়, সে বিষয়ে মিশনারিজ কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট কোনো হিসাব নেই।
তহবিল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অধিকাংশ সময় তাঁদের উত্তর হয়, তাঁরা তাদের দুয়ারে আসা প্রতিটি মুখে অন্ন তুলে দেন। এটাই ভালোবাসার অপার মহিমা।
মিশনারিজের এ উত্তর সমালোচকদের কাছে যথেষ্ট নয়। তাদের যুক্তি, দ্য রেড ক্রস বা অক্সফামের মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠান যদি তাদের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে পারে, তবে একই জবাবদিহি মিশনারিজ অব চ্যারিটিরও থাকা উচিত। শুধু ধর্মের নামে বা ভ্যাটিকানের প্রভাবে তাদের ছাড় পাওয়া উচিত নয়।
আরও পড়ুন
কলকাতায় এসে যেভাবে হয়ে উঠেছিলেন মাদার তেরেসা
সমালোচনার পেছনের বাস্তবতা
সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য এবং তার অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে মাদার তেরেসার সমালোচকেরা আর্তমানবতার সেবায় তাঁর ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাজের সমালোচনা করেন।
কিন্তু কোন সময়ে, দেশের কোন পরিস্থিতিতে তিনি অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা তাঁরা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেন। তাঁরা একটি দারিদ্র্যপীড়িত, উপনিবেশোত্তর শহরে আধুনিক মানের পশ্চিমা চিকিৎসা পাওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন।
এমন নয় যে মাদার তেরেসা নিখুঁত মানুষ ছিলেন। তাঁর মধ্যে ধর্মান্ধতা ছিল। ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ের পর দেওয়া বক্তৃতায় ‘গর্ভপাতকে শান্তির সবচেয়ে বড় ধ্বংসকারী’ বলে অনেকের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিলেন।
এটা ঠিক যে, মাদার তেরেসা ধর্ম প্রচার করতেই ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তবে ভারতে এসে দেশটির যন্ত্রণাকাতর ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সেবায় এই মহীয়সী নারী যে নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করছেন, তা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। তাঁকে অস্বীকার করা মানে ওই সব লাখো মানুষকে অস্বীকার করা, যাঁরা তাঁর সেবা পেয়েছেন।
২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসাকে সন্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সে সময়ের ধর্মগুরু প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস এ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
মাদার তেরেসা সন্ত স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাঁর ৩০ বছরের সহকর্মী সুনীতা কুমার বলেছিলেন, ‘তিনি ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। ফলে তাঁর কাউকে ধর্মান্তরিত করার প্রশ্নই ওঠে না। সেটা কখনোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। আর তাই যদি হত আমার তো মনে হয়, গোটা ভারত এত দিনে খ্রিষ্টান হয়ে যেত।’
মিশনারিজ অব চ্যারিটি এখনো বিশ্বের সবচেয়ে দারিদ্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় কাজ করে যাচ্ছে। প্রায়শই কোনো প্রচার ছাড়া তাঁরা এমন সব পরিস্থিতিতে কাজ করেন, যা অনেকের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।